নিজস্ব প্রতিবেদক :
একজন ব্যাংক কর্মকর্তার নেতৃত্বে রাজশাহীতেও গড়ে উঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস চক্র। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এ চক্রের তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এরা অন্তত তিন কোটি ৩৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে সিআইডি জানিয়েছে।
গ্রেপ্তার তিনজন হলেন- অগ্রণী ব্যাংকের রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের এগ্রি শাখার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মানিক কুমার প্রামানিক (৩৮), তার ব্যক্তিগত সহকারী শাফিকুল ইসলাম (৩০) এবং মামাতো ভাই রিপন কুমার (২৬)। মানিক কুমারের বাড়ি রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার কেশরহাট পৌরসভার ধামিন নওগাঁ মহল্লায়। শাফিকুলের বাড়ি মোহনপুরের সাকোঁয়া গ্রামে। আর রিপনের বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার কুসুম্বা। তিনি জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র।
বুধবার দিবাগত রাতে রাজশাহী মহানগরীর বিনোদপুর এলাকার একটি ভাড়া বাড়ি থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সিআইডির ঢাকা থেকে আসা একটি দল অভিযান চালায়। রাজশাহী মেট্রোপলিটন সিআইডি এতে সহায়তা করে। মূলত ঢাকায় তিননজনকে গ্রেপ্তারের পর রাজশাহীর মানিকের ব্যাপারে তথ্য পায় সিআইডি। এরপরই এখানে অভিযান চালানো হয়। ঢাকায় গ্রেপ্তার তিনজন হলেন- জনতা ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রকিবুল হাসান শান্ত (২৫) এবং তার সহযোগী রাশেদুজ্জামান সজীব (৩৬) ও হাসান মাহমুদ (২২)। এরা প্রত্যেকে বিপুল সম্পদের মালিক।
রাজশাহীর কেশরহাট পৌরসভার মেয়র শহিদুজ্জামান শহিদ বলেন, মানিক কুমার প্রামানিক এলাকার ছেলে। এমনিতে খুব ভদ্র। দেখা হলে সালাম-কালাম দেয়। কিন্তু কার ভেতরে যে কী আছে তা তো জানি না। মেয়র জানান, কেশরহাট বাজারে মানিকের বাবা রতন কুমার দুলালের একটি মুদি দোকান ছিল। রতনের মৃত্যুর পর তার আরেক ছেলে হীরা দোকানটা চালাতেন। এখন তারা দোকান চালান না। হীরা এখন জায়গা-জমি দেখাশোনা করে। আর দোকানটা এক চাচাতো ভাইকে দিয়েছেন। মানিকের অগ্রণী ব্যাংকে চাকরি হয়েছে ২০১২ সালে। তার আরেক ভাই মুক্তা একজন চিকিৎসক।
সিআইডির রাজশাহীর পরিদর্শক আনিসুর রহমান বলেন, বিনোদপুরে মানিকসহ তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর রাতেই তার গ্রামের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। এখন মানিকের যে বাড়ি সেরকম বাড়ি এলাকাতে আর কারও নেই। খুবই আলিসান বাড়ি। গত তিন বছর ধরে অন্তত সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা খরচ করে বাড়িটা বানানো হয়েছে। বাড়িতে মানিকের একটা গাড়িও পাওয়া গেছে। সেটির দাম অন্তত ৫০ লাখ টাকা। এছাড়া বাড়িতে ব্যাংকের ১০-১২টা চেক বই পাওয়া গেছে। একটা ল্যাপটপ এবং চারটা ডায়েরিও জব্দ করা হয়েছে। এসবে প্রশ্ন বিক্রির হিসাব রয়েছে।
সিআইডি জানিয়েছে, ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে নাফিউল ইসলাম ওরফে তাহসিন (১৮) নামে এক শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। তার মোবাইল ফোনে পাওয়া যায় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের সমাধান। ওই ঘটনায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে একটি মামলা হয়। মামলার তদন্তে জালিয়াতি চক্রের সন্ধান পাওয়া যায়। চক্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি করে আসছিল। গত ২২ ডিসেম্বর চক্রের দুই সদস্য হাসান মাহমুদ ও রাশেদুজ্জামান সজীবকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে পরীক্ষায় জালিয়াতির অপরাধ স্বীকার করে সজীব আদালতে জবানবন্দি দেন।
জিজ্ঞাসাবাদে সজীব জানিয়েছেন, তিনি সাইফুরস কোচিং সেন্টারে ইংরেজি বিষয়ক শিক্ষক ছিলেন। জালিয়াতি চক্রে তার কাজ ছিল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার ইংরেজি অংশের সমাধান করা। ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে তারা কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করতেন এবং চুক্তি অনুযায়ী পরীক্ষার্থীর কাছে সঠিক উত্তর পৌঁছে দিতেন। শান্ত নামে একজনের মাধ্যমে তিনি এই চক্রে যুক্ত হয়েছিলেন। এরপর ২৭ ডিসেম্বর মতিঝিল থেকে শান্তকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মানিক কুমার প্রামানিক এবং তার দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাজশাহীর ব্যাংক কর্মকর্তা মানিক কুমার প্রামানিক শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রার্থীদের সঙ্গে চুক্তি করতেন। টাকা নিতেন। মানিক প্রশ্নফাঁস চক্রের ‘দ্বিতীয় প্রধান’ ছিলেন।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক কামরুল আহসান জানিয়েছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই চক্রটি তিন ভাগে কাজ করত। এক ভাগের দায়িত্ব ছিল ছাত্র সংগ্রহ করা, একটি ভাগ ফাঁস করা প্রশ্নপত্রের সমাধান করত এবং আরেক ভাগ পরীক্ষার কেন্দ্র দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত ছিল। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে এবং প্রশ্নপত্র সমাধানের জন্য মানিক বিভিন্নজনের কাছ থেকে তিন কোটি ৩৯ লাখ টাকা সংগ্রহ করেছেন। মানিককে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার অনেক আগে থেকেই ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী এবং চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তাঁদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করতেন এবং পরীক্ষা চলাকালে তাঁরা ডিজিটাল ডিভাইসে সহায়তা করতেন।
তিনি আরও জানান, চক্রের সদস্যরা এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংকের দুবারের নিয়োগ পরীক্ষা, ২০১৯ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ক’ ইউনিটের ২০১৭ ও ২০১৮ সালের প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে। চক্রটি হোয়াটস অ্যাপে গ্রুপ খুলত। তাতে যাঁরা অবৈধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কিংবা চাকরি নিতে চান, তাঁরা যুক্ত হতেন। পরে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পরীক্ষার ১০ থেকে ১৫ মিনিট আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দিতেন। এরপর চক্রের সদস্যরা সমাধান করে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ছেড়ে দিতেন। এই চক্রে ১০ জনের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। চক্রের মূল হোতাসহ বাকিদের গ্রেপ্তারের অভিযান চলছে। এছাড়া মানিক কুমার প্রামাণিককে জিজ্ঞাসাবাদে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। যাঁরা জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং চাকরিতে যোগদান করেছেন, তাঁদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে।